মোরাকাবা
بسم الله الرحمن الرحيم
মোরাকাবার বিবরণ
১। প্রশ্ন - মোরাকাবা কাহাকে বলে ?
উত্তর - (আমলী জিকিরের পরে জিকিরে মা’রুফ বা প্রচলিত) জিকির দুই প্রকার, জিকিরে লেছানী অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে জবান দ্বারা স্মরণ করা। আর জিকিরে ক্বলবী অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে অন্তর দ্বারা স্মরণ করা। এই জিকিরে ক্বলবী মোরাকাবা বলে।
কুরআন মজীদে আছে –
واذكر ربك فى نفسك الايه
অর্থ – এবং তুমি তোমার প্রতিপালককে অন্তরে অন্তরে জিকির কর।
বর্ণিত আয়াতে জিকিরের আদেশটি আত্মা সম্বন্ধীয় মাছয়ালা, যাহা তাছাওউফ সম্পর্কীয়। এই জিকির হইতে গাফেল থাকিতে আল্লাহ তা’আলা নিষেধ করিয়াছেন।
২। প্রশ্ন - তাফাক্কুর মোরাকাবার অর্ন্তভুক্ত কি না ? তাফাক্কুর সম্বন্ধে কুরআন মজীদে বর্ণনা আছে কি না ?
উত্তর - তাফাক্কুর এক প্রকারের মোরাকাবা। কুরআন মজীদের ৪র্থ পারাতে সূরা-আল-ইমরানের ১৯০-১৯১নং আয়াতে আছে –
ان فى خلق السموات والارض واختلاف اليل والنهار لايت لاولى الالباب * الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلى جنوبهم ويتفكرون فى خلق السموات والارض – ربنا ما خلقت هذا باطلا * سبحانك فقنا عذاب النار-
অর্থাৎ – নিশ্চয় আছমান সমূহ ও জমিনের সৃষ্টির ভিতরে এবং দিবারাত্রির পরিবর্তনের ভিতরে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন সমূহ রহিয়াছে। যাহারা (ঐ জ্ঞানবান লোকেরা) আল্লাহ তা’য়ালার জিকির দাঁড়ান, উপবেশন ও শায়িত অবস্থাতে করিতেছে এবং আছমান ও জমিনের সৃষ্টির কৌশল সম্বন্ধে গবেষণা করিতেছে।
বিশ্ব নবীর ছাহাবারা জবান দ্বারা আল্লাহর জিকির করিতেন এবং আল্লাহ তা’য়ালার ছিফাত (ও সৃষ্টিকৌশল) সম্বন্ধে সর্বদা ধ্যান করিতেন।
ছাহাবারা আছমান ও জমিনের সৃষ্টির গবেষনা করিয়া বলিয়াছেন-
ربنا ما خلقت هذا با طلا * سبحا نك فقنا عذاب النار
অর্থাৎ - হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আছমান ও জমিনের ভিতরে কোন জিনিস অনর্থক সৃষ্টি কর নাই। হে আল্লাহ, তোমাকে আমরা পবিত্র বলে বিশ্বাস ও বর্ণনা করি। সুতরাং আমাদিগকে দোযখের আযাব হইতে রক্ষা কর’’।
প্রকাশ থাকে যে, নায়েবে রাছুলেরা মুরীদগণকে মোরাকাবা শিক্ষাদান করিয়া বর্ণিত আয়াতের উপর আমল করাইতেছেন।
☆ তাফাক্কুরের বিশেষ বর্ণনা -
৩। প্রশ্ন - তাফাক্কুর কাহাকে বলে ?
উত্তর - দুইটি জানিত জিনিসের দ্বারা তৃতীয় একটি অজানিত জিনিসের ইলেম অন্তরে হাছিল করার নাম তাফাক্কুর। যেমন একটি জিনিস হইল অস্থায়ী জিনিসের থেকে স্থায়ী জিনিস উত্তম দ্বিতীয় জিনিস হইল ইহজগত অস্থায়ী আর পরজগত চিরস্থায়ী। এই দুইটি জিনিসের দ্বারা ছাবেত হইল ৩য় একটি অজানিত জিনিস তাহা হইল ইহজগত হইতে পরজগত উত্তম।
যাহারা ইহজগতের মোহে মুগ্ধ হইয়া পরজগতের কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে, তাহাদের জন্য এই তাফাক্কুর অতি জরুরী কাজ।
ফিকির দ্বারা ইল্ম হাছিল হয়, ইল্মের ছববে অন্তরে হালত পরিবর্তন হয়, ইহাতে আমল পরিবর্তন হয়; কেননা আমল তাবে হালের, হাল তাবে ইলমের, ইলম তাবে তাফাক্কুরের। ইহাতে পরিস্কার বুঝা গেল সমস্ত আমলের আসল বা মূল তাফাক্কুর। এই তাফাক্কুর জিক্রে লেছানী হইতে উত্তম। এই জন্য হাদীসে লিখা আছে, এক ঘন্টার তাফাক্কুর ৬০ বৎসর এবাদত হইতে উত্তম। ১ এই তাফাক্কুরের ছববে পরজগত হাছিলের জন্য আত্মার এক খাহেশ (আগ্রহ) পয়দা হয়।
১ তাফছীরে রুহুল মায়ানীর বরাত দিয়া তা’লীমে মারেফাতের পুরান ছাপা ২৭নং পৃষ্ঠায় এবং ইসলাম ও তাছাওউফ কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় উক্ত হাদীসখানা সুস্পষ্টভাবে লিখা আছে।-প্রকাশক।
☆ তাফাক্কুরের শ্রেনী বিভাগ সম্পর্কীয় বর্ণনা -
৪। প্রশ্ন - তাফাক্কুর বা গবেষণা কত প্রকার ?
উত্তর - তাফাক্কুর দুই প্রকার। যথা- প্রথম প্রকার- পরজগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, দ্বিতীয় প্রকার- ইহ জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এক্ষণে, পরজগত সম্বন্ধীয় তাফাক্কুরের বর্ণনা করা হইতেছে।
পরজগতের উদ্দেশ্যে তাফাক্কুর -
আল্লাহ তা’য়ালা এবং বান্দার ভিতরে মোয়ামালাত (করনীয় কাজ) যাহা আছে তাহা দুই প্রকার- প্রথম বান্দার ছিফাত ও হালতের গবেষণা।
বান্দার ছিফাত ও হালত দুই ভাগে বিভক্ত- প্রথম ভাগ- ছিফাত ও হালত আছে যাহা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। দ্বিতীয় ভাগ- ছিফাত ও হালত আছে যাহা আল্লাহ তায়ালার নিকট পছন্দনীয় নহে। যাহা পছন্দনীয় তাহা অর্জন করার চেষ্টা করা, আর যাহা পছন্দনীয় নহে, তাহা বর্জন করার চেষ্টা করা।
যে গবেষণা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাহা দুই ভাগে বিভক্ত। যথা- প্রথম আল্লাহর জাত সম্পর্কীয়, দ্বিতীয়- আল্লাহর ছিফাত সম্পর্কীয়।
যে ব্যক্তি আল্লাহর দিদারের ইচ্ছা রাখে, তাহার অবস্থা আশেক লোকের মিছাল। যে ব্যক্তি আশেক, তাহার গবেষণা থাকে শুধু দুই চিজের উপর। যথা-
☞ প্রথম- মাশুকের উপর অর্থাৎ মাশুকের ছুরত, আফয়াল, আখলাকের উপর। ইহাতে তাহার দেলে এক প্রকার লজ্জত, মুহব্বত মা’লূম হইতে থাকে।
☞ দ্বিতীয়- নিজের উপর যখন নিজের উপর হইবে তখন প্রথম- ফেকের হইবে উহার উপর যাহা মাশুকের না পছন্দ, উদ্দেশ্য এই যে, উহা তরক (পরিত্যাগ) করিবে। দ্বিতীয়- ফিকির বা গবেষণা হইবে ঐ সমস্ত বিষয়ের উপর যাহা মাশুকের না পছন্দ, উদ্দেশ্য এই যে, উহা তরক (পরিত্যাগ) করিবে। দ্বিতীয়- ফিকির বা গবেষণা হইবে ঐ সমস্ত বিষয়ের উপর যাহা মাশুকের কাছে পছন্দনীয়। উদ্দেশ্য এই যে, উহা নিজের মধ্যে হাছিল করিবে।
মোটকথা, প্রথম- নিজের উপর তাফাক্কুর করিতে হয় যে, আল্লাহ তায়ালার কাছে কোন্ কাজ পছন্দ বা প্রিয় আর কোন কাজ অপছন্দনীয় বা অপ্রিয়।
আল্লাহ তা’য়ালার কাছে যাহা পছন্দ বা অপছন্দ তাহা দুই প্রকার।
☞ প্রথম- জাহেরী, যেমন- তা’য়াত এবং মায়া’ছী।
☞ দ্বিতীয়- বাতেনী যেমন- মুন্জিয়াত ও মুহ্লিকাত অর্থাৎ সৎ- স্বভাব ও অসৎ স্বভাব এই দুই চিজের আমলের মহল (স্থান) হইয়াছে দেল।
প্রত্যেক ছালেকের ফেকের বা গবেষণা করিতে হইবে যে, জাহেরী আমল দ্বারা আল্লাহর না পছন্দ কাজ করিয়াছে কি না ? যদি করিয়া থাকে, তবে দেখিবে সর্ব শরীর দ্বারা ? না কোন এক অজুদ (অংগ) দ্বারা ? সর্ব শরীর দ্বারা অথবা যে কোন অজুদ দ্বারা করিয়া থাকিলে উভয় অবস্থায়ই শরীয়ত মোতাবেক যাহা প্রতিকার আছে তাহা করিবে।
পুনঃ গবেষণা করিতে হইবে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় কাজ যাহা করা তাহার কর্তব্য ছিল, তাহা করিয়াছে কি না ? যদি না করিয়া থাকে, তবে শরীয়তের বিধানমতে যাহা করণীয় আছে তাহা করিবে।
আল্লাহ তা’য়ালার ছিফাত ও আফয়াল সম্বন্ধীয় তাফাক্কুরের বর্ণনা -
দ্বিতীয় প্রকারের তাফাক্কুর করিতে হইবে আল্লাহ তায়ালার ছিফাত ও আফয়াল সম্বন্ধে। ইহাতে আল্লাহর মহত্ব অন্তরে জাগরিত হইতে থাকিবে। মানব, পশু, জীন, পক্ষী ইত্যাদি সমস্ত মাখ্লুকাতের সৃষ্টির কৌশলের দিকে তাফাক্কুর করিলে এমনকি শুধু আছমানের চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রের দিকে তাফাক্কুর করিলে আল্লাহর মহত্ব স্ব- প্রমান হইতে থাকে। [আছমান ও জমিনের সৃষ্টি কৌশল এবং রাত্র দিনের পরিবর্তন ইত্যাদির দিকেও তাফাক্কুর করিলে আল্লাহর মহত্ব ও কুদরাতের স্ব- প্রমাণ হইতে থাকে।] মানুষের ফায়দার জন্য পৃথিবীর সমস্ত মাখলুকাত পয়দা করা হইয়াছে।
এই তাফাক্কুর যখন অন্তরে জাগরিত হইতে থাকে, তখন আল্লাহর মুহব্বত অন্তরে পয়দা হইতে থাকে। যখন মহব্বত পয়দা হয়, তখন আল্লাহর বন্দেগীতে নিজকে ফানা করিয়া দিতে ইচ্ছা হয়।
৫। প্রশ্ন - যে সমস্ত ত্বরীকাত পন্থীরা তাফাক্কুরের মাছয়ালা হইতে বেখবর, শুধু চক্ষু বুঝিয়া (বন্ধ) করিয়া বসিয়া থাকে, তাহাতে তাফাক্কুরের দরজা হাছিল হয় কি না ?
উত্তর - যাহারা তাফাক্কুর করিতে চাহে, তাহাদের তাফাক্কুরের মাছয়ালা শিক্ষা না করিয়া শুধু মাত্র চক্ষু বুঝিয়া বসিয়া থাকিলে ইহাতে তাফাক্কুরের দরজা হাছিল হইবে না। যেমন- নামাজের মাছয়ালা শিক্ষা না করিয়া নামাজ পড়িলে নামাজ ছহীহ্ হয় না।
৬। প্রশ্ন - শরীয়তের চার ভাগ মাছয়ালার মধ্যে যাহারা শুধু দুই ভাগ ফিক্বাহ্র মাছয়ালা ইবাদত আর মোয়া’মালাত শিক্ষা করিয়াছে, তাছাওউফ শিক্ষা করে নাই, তাহাদের তাফাক্কুরের দরজা হাছিল হইয়াছে কি না ?
উত্তর - ফিক্বাহের মাছয়ালা শিক্ষা করা যেরূপ ফরজ, তদ্রুপ তাছাওউফের মাছয়ালা শিক্ষা করাও ফরজ। এই ফরজ বাদ দিয়া যাহারা তাফাক্কুর করিতেছে তাহাদের তাফাক্কুরের দরজা হাছিল হয় নাই।
৭। প্রশ্ন - মোরাকাবা কিভাবে হাছিল হয় ?
উত্তর - আল্লাহ তা’য়ালা আছমান জমিন অর্থাৎ সমস্ত মাখলুকাতে যাহা আছে, তাহার খবর রাখেন। আল্লাহ তা’য়ালার অগোচরে কোন জিনিস নাই, বান্দা যাহা করিতেছে আল্লাহ তায়ালা সবকিছু দেখিতেছেন, এই ইল্ম যখন বান্দার হাছিল হয়, তখন তাহার অন্তরে এক হালত পয়দা হয়। এই হালতের ছববে (কারণে) অন্তরে এবং বাহ্যিক শরীরে আমল পয়দা হইতে থাকে, তখন বান্দার ধ্যান আল্লাহ তা’য়ালার জাত এবং ছিফাতের দিকে ধাবিত হয়, এই ধ্যানকে মোরাকাবা বলে।
এই মোরাকাবা যাহাদের হাছিল হয় তাহারা দুই প্রকার, প্রথম ছিদ্দীক, দ্বিতীয় আছহাবে ইয়ামিন। ছিদ্দীক লোকেরা আল্লাহ তা’য়ালার ছিফাতে জামালের ধ্যানে এইরূপ রত হয় যে তাহাদের কোন হুঁশ থাকেনা। অর্থাৎ ছিদ্দীক লোকেরা যে ধ্যানে থাকে তাহা ছাড়া অন্য কোন খবর রাখেনা। (ইহা অর্জন করা কাহারও এখতিয়ার ভুক্ত নহে। আর বেহুঁশ হওয়া প্রয়োজনও নহে।)
আর এক দরজার মোরাকাবা আছহাবে ইয়ামিনদের। তাহাদের ইয়াকীন আছে, আল্লাহ তা’য়ালা জাহের, বাতেন সব খবর রাখেন, কিন্তুু তাহারা আল্লাহ তায়ালার ছেফাতে জামালের ধ্যানে বেহুঁশ হননা। তাহাদের হুঁশ ঠিক মতই (ভাবেই) থাকে। তাহারা প্রত্যেক কাজ করিতে চিন্তা করেন। যদি দেখেন কাজটা আল্লাহর ওয়াস্তে হইতেছে, তাহা হইলে করিতে থাকেন। আর যদি দেখেন কাজটা নফছের তাড়নায় হয়, তবে সে কাজটা করেন না। তাহারা তাহাদের যাবতীয় কাজের উপর এইরূপ ধ্যান রাখিয়া কাজ করিয়া যাইতে থাকেন। তাহারা বিশুদ্ধ অন্তরে শরীয়তের চার ভাগ মাছয়ালা এবাদত, মোয়ামালাত, মুহ্লিকাত, মুনজিয়াত এর উপর আমল করিয়া থাকেন। তাহাদের কোন রিয়া নাই, তাহারা যাহা কিছু করিয়া থাকেন, তাহা ইখলাছের সহিত করেন অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর ভয়েতে করিয়া থাকেন। তাহারা দুনিয়ার কাজ কারবারও রীতিমত করিয়া থাকেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ইত্যাদি পরিবার বর্গের হক হকুক শরীয়তের বিধান মতে আদায় করেন।
☆ মানুষের তিনটি বিশেষ অবস্থা -
মানুষ তিন অবস্থার থেকে খালী নহে, তায়াত, মা’ছিয়াত, মোবাহ্। মানুষ এই তিন কাজের যে কোন কাজে থাকিবে। যদি তয়াতে (আল্লাহর আনুগত্যে) থাকে, তবে তাহার মোরাকাবা হইল ইখলাছের সহিত করিবে।
আর মা’ছিয়াত হইলে (গুনাহের কাজ করিলে) উহার মোরাকাবা হইল তওবা, কাজা, কাফ্ফারা (ইত্যাদি যাহাই তাহার উপর শরীয়তের বিধানমতে ধার্য হয়, তাহা পালন করা) ও পুনঃ গুনাহের কাজে লিপ্ত না হওয়া। আর মোবাহ্ কাজের মোরাকাবা হইল নেয়ামতের শোকর আদায় করা।
☆ অতি প্রয়োজনীয় সাবধান বাণী -
মোরাকাবার মাছয়ালা না জানিয়া শুধু চক্ষু বুঝিয়া বসিয়া থাকিলে মোরাকাবার দরজা হাছিল হয় না। মোরাকাবা শুধু চক্ষু বুঝিয়া করিতে হয় না বরং চক্ষু মেলিয়াও করিতে হয়। (বর্তমান দুনিয়ায় সাধারনত-চক্ষু বন্ধ প্রচলিত নফল মোরাকাবাকেই মোরাকাবা ধারনা করা হয়, কিতাবের বিধান মতে যাহা মূলত আসল বা প্রকৃত মোরাকাবা, তাহা করা হয় না, এমন কি আসল বা প্রকৃত মোরাকাবা সম্বন্ধে কোন সঠিক ধারনাও নাই। তাই মুজাদ্দিদে আ’যম (রহঃ) উপরোক্ত সতর্কবাণী ঘোষণা করিয়াছেন। [প্রকাশক] মোটকথা - আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের চব্বিশ ঘন্টাকাল মোরাকাবা হইতেছে। (যদিও বাহ্যিকভাবে দেখা যায় যে, তাহারা ধর্মীয় ও দুনিয়াবী সমস্ত কাজ-কর্ম বাদ দিয়া পাহাড়-জঙ্গলে বা নির্জনে গিয়া সব সময় চক্ষু বন্ধ জিকির মুরাকাবায় মশগুল থাকেন না।)
☆ জিকিরের শ্রেণী বিভাগ ও জিক্রে লেছানীর বিধান -
৮। প্রশ্ন - জিকির কত প্রকার ?
উত্তর - (আমলী জিকিরের পরে জিক্রে মারুফ বা প্রচলিত) জিকির দুই প্রকার-জিক্রে ক্বলবী, জিক্রে লেছানী। মস্জিদে বা অন্য কোন স্থানে বসিয়া জামাতের সঙ্গে বোলন্দ আওয়াজে জিকির করা মোস্তাহাব। যথা- শামি কিতাবের ১ম জিলদের (কাদীম ছাপা) ৬১৮ পৃষ্ঠায় লিখা আছে –
اجمع العلماء سلفا وخلفا على استحباب ذكر الجماعة فى المساجد وغيرها الا ان يشوش جهر هم على نائم اومصلى اوقارى –
অর্থাৎ – পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামাগণ মস্জিদে বা অন্য কোন জায়গায় জামাতের সহিত স্পষ্ট আওয়াজে জিকির করা মোস্তাহাব বলিয়া ইজমা বা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, কিন্তু জিকিরের আওয়াজ এরূপ উচ্চ না হয়, যাহাতে নিদ্রা, নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াতে ব্যাঘাত জন্মে।
প্রচলিত নফল জিকিরের দ্বারা অন্তরের রাজায়েল দূরীভূত হয় কি না ?
তাহার দলীল ভিত্তিক বিস্তারিত বিবরণ ঃ-
৯। প্রশ্ন ঃ- জিকির দ্বারা অন্তরের রাযায়েল অর্থাৎ অসৎ স্বভাব দূর হয় কি না ?
উত্তর - মাওলানা কারামত আলী ছাহেবের জখিরায় কারামত কিতাবের প্রথম খন্ডের নবম পৃষ্ঠায় লিখা আছে -
كنوين مين اكربلى مرى اورسرى اور يهولى نهين تو بلى كوكنويى سي نكل يهينك كى سائه ذول يانى كنوين كا نكل دالى كنوان ياك هو جاوى اوراكر بلى كنوين مين يرى رهى تويانى نكالنا كجه فائده نه كرى – اسيطرح سى جبتك نفس كا تزكيه نه هوكا كوئى ذكر اور عبادت اور مراقبه فائده نه كريكا –
অর্থ – কুপের ভিতরে বিড়াল মরিয়া থাকিলে উহা যদি ফুলিয়া পঁচিয়া গলিয়া না থাকে তবে ক‚প থেকে ষাট (৬০) ডোল পানি উঠাইয়া ফেলিলে ক‚প পবিত্র হইয়া যায়, কিন্তু মরা বিড়াল না তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলে কোন ফায়দা হয় না। তদ্রুপ অন্তরকে কু-রিপুসমূহ হইতে পবিত্র না করিয়া অর্থাৎ অন্তরে কু রিপুসমূহ থাকা অবস্থায় যে কোন জিকির ও ইবাদত এবং মোরাকাবা করিবে উহাতে ফায়দা (উক্ত ব্যাপারে উপকার ) হইবে না।
হযরত মাওলানা মোঃ আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) সাহেবের মলফুজাতে হেচ্ছায় হাপ্তমে (সপ্তম খন্ডে) লিখা আছে ঃ-
اورنرى ذكر و شغل س اصلاح هو بهى كيسى سكتى هى اسلئى كه هر رذيله كا علاج جداكانه هى اكر ايك رذيله بهى باقى رهى كا تو راسته اسوقت تك بند هى بلكه ذكر سى بعض مرتبه فاسد الا ستعداد كا مرض برره جاتا هى –
অর্থ – শুধু নফল জিকির শোগল দ্বারা আত্মার এছলাহ্ হইবেই বা কিরূপে ? কারণ প্রত্যেকটি রিপুর ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন। যদি আত্মার একটি রিপুও বাকী থাকে, তবে বেহেশ্তের রাস্তা বন্ধ থাকিয়া যায়। বরং জিকিরের দ্বারা আত্মার রোগ কোন কোন সময় আরও বৃদ্ধি পায়।
১০। প্রশ্ন - জিকির দ্বারা অন্তরের রাযায়েল দূর না হইলে দূর করার পন্থা বা এ’লাজ কি ?
উত্তর - শামী কিতাবের ১ম খন্ডে (কাদীম ছাপা ৪০ পৃষ্ঠায়) লিখা আছে ঃ-
ولايمكن الا بمعرفة حدودها واسبابها وعلاماتها وعلا جها –
মূল অর্থ – অন্তরের রাযায়েল দূর করা সম্ভব হইবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেকটি রাযায়েলের তারিফ, ছবব, আমালত ও এলাজের মাছয়ালা অবগত না হইবে।
পরিস্কার বুঝা গেল, অন্তরের রাযায়েল দূর করার পন্থা বা এ’লাজ হইয়াছে তাছাওউফের বর্ণিত মাছায়েল।
১১। প্রশ্ন - নফল জিকির দ্বারা অন্তরের রাজায়েল দূর না হইলে প্রচলিত ত্বরীকত পন্থীরা জিকির করিতেছে কি জন্য ?
উত্তর - অন্তরের রাজায়েল ছাড়া আর একটি ময়লা আছে। তাহা গুনাহের ছববে অন্তরে পতিত হয়। তাহা দূর করার জন্য জিকিরের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। যথাঃ হাদীছে আছে- মূলঅর্থ- নিশ্চয় ঈমানদার ব্যক্তি যখন কোন একটি গুনাহ্ করে তখন তাহার অন্তরে কাল দাগ পড়িয়া যায়, অতঃপর যখন সে তওবা করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন তাহার অন্তর (উহা হইতে) ছাপ হইয়া যায়। আর যদি সে গুনাহ করিতে থাকে আর তওবা ও জিকির না করে তবে তাহার অন্তরে কাল দাগ পড়িতে পড়িতে অন্তরের জ্যোতি নিভিয়া যায়।
☆ প্রকৃত জাকের ও গাফেলের পরিচয় -
১২। প্রশ্ন - জাকের কাহাকে বলে ? এবং গাফেল কাহাকে বলে ?
উত্তর - যাহারা জবান দ্বারা বা অন্তর দ্বারা জিকির করিতেছে এবং আহ্কামে জাহেরী এবং আহ্কামে বাতেনীর উপর আমল করিয়া যাইতেছে, তাহাদিগকে জাকের বলে। আর যাহারা আহকামে জাহেরী এবং আহকামে বাতেনীর উপর আমল করিতেছে না, তাহারা যদি দিবা রাত্র (প্রচলিত নফল মোস্তাহাব) জিকির এবং মোরাকাবায় রত থাকে, তবুও তাহারা জাকের শ্রেণী ভুক্ত হইতে পারে না, তাহারা গাফেল শ্রেণীভুক্ত ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন